অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘পদত্যাগের গুঞ্জন’ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপির প্রতিনিধিরা। গতকাল শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ধাপে ধাপে টানা কয়েক ঘণ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করেন ড. ইউনূস। আলোচনা সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সংস্কার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর জোর দেওয়া হয়। একইসঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংগঠিত গণহত্যার বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার তাগাদা দেওয়া হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে।
গতকাল বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি কখনওই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি, বরং প্রথম দিন থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছে। দেশের গণতন্ত্র উত্তরণের লক্ষ্যে বিএনপি প্রথম থেকেই একটি সুস্পষ্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এবং সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
তিনি বলেন, বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মী পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, এজন্য আওয়ামী লীগের বিচারের দাবি সবচেয়ে বেশি বিএনপির। এই বিচারপ্রক্রিয়া কোনোভাবে অসম্পন্ন থেকে গেলে বিএনপি সরকারের দায়িত্বে গেলে বিচারের আওতায় এনে তা স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করবে।
মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশের মানুষ বিশ্বাস করে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র উত্তরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা। যে কোনো উছিলায় নির্বাচন যত বিলম্ব করা হবে আমরা মনে করি জাতির কাছে আবার স্বৈরাচার পুনরায় ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর দায়-দায়িত্ব বর্তমান সরকার এবং তাদের সংশ্লিষ্টদের ওপরে বর্তাবে।
জানা গেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মতভিন্নতা, ছোট-বড় ও ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে রাস্তা অবরোধ, অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দলগুলোর অসহযোগিতা, প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের গুঞ্জন’ সব মিলিয়ে রাজনীতিতে হঠাৎ উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। ওই উৎকণ্ঠার মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেন মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে বিএনপির পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে মূলত দুটি বিষয়ে স্পষ্ট রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। প্রথমত- নির্বাচনটা কখন হবে? আপনি যে সময়সীমা দিয়েছেন, এর ভিতরেই জনগণের কোনো বড় ধরনের ভোগান্তি না হয়ে একটা কমফোর্টেবল টাইমে নির্বাচনটা হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত- এই নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার এবং বিচারের কিছু দৃশ্যমান প্রক্রিয়া জনগণের সামনে আসতে হবে। জামায়াত আমির আরও বলেন, সংস্কার শেষ না করে যদি কোনো নির্বাচন হয়, এই নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আবার সব সংস্কার এখন করা সম্ভবও নয়। মাত্র পাঁচটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) হাত দিয়েছেন। এতটুকু নিষ্পত্তি করা দরকার সন্তোষজনকভাবে।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি থেকে কোনো কোনো পক্ষ সরে গেছে বলে মনে করছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওনাকে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে। এভাবে ওনার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। সংস্কার বা পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সেই জায়গা থেকে উনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আমাদের (এনসিপি) জায়গা থেকে আমরা বলেছি, কোনো রাজনৈতিক দল নয়, উনি যেন জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হোন। সেই জায়গায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাজ করতে দৃঢ়তা ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের মধ্যে আরও ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমদ। অন্যদিকে জামায়াতের দুই সদস্যের প্রতিনিধির মধ্যে ছিলেন নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এছাড়াও এনসিপির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করেন মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে এনসিপির প্রতিনিধি দলের ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ও সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।